বুধবার, ০৯ Jul ২০২৫, ০৯:০৬ অপরাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
দিনের আলো শেষ হতেই কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আতঙ্ক আর ভয় নেমে আসে। প্রত্যাবাসনের পক্ষে সোচ্চার রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা এবং তার এক মাসের মাথায় উখিয়ার একটি মাদ্রাসায় সন্ত্রাসী হামলায় ৬ রোহিঙ্গা নিহতের পর থেকে ক্যাম্পের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা আরও ভেঙে পড়েছে। ওই পথ দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারাও যেতে সাহস পায় না সন্ধ্যার পর। মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে মিয়ানমারে ফিরে যেতে ইচ্ছুক সাধারণ রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে। ক্যাম্পের ভেতরে আরসাসহ অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয়। তারা ক্যাম্পে আরও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও স্থানীয়রা বলছেন, মিয়ানমারের পৃষ্ঠপোষকতায় রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো আরও সক্রিয়া হয়ে উঠছে। মুহিবুল্লাহ হত্যা, মাদ্রাসায় হামলার মাধ্যমে তারা শিবিরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এর মূল কারণ হলো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বন্ধ করা। তারা আরও বলেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা থামাতে না পারলে দেশের সবচেয়ে বড় পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার হুমকির মুখে পড়বে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে।
মুহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে সাধারণ রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে আতঙ্কে সময় পার করছে। আগে তারা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলেও এখন কেউই মুখ খুলছে না। এরপর উখিয়ার থাইনখালী (ক্যাম্প-১৮) ক্যম্পের মাঝামাঝি একটি সড়কের পাশে টিনের ছাউনি দেওয়া মাদ্রাসায় সন্ত্রাসী হামলায় ৬ রোহিঙ্গার নিহত হওয়ার ঘটনায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প আরও অস্থির হয়ে ওঠে।
স্থানীয় ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিদের যোগাযোগ রয়েছে। ক্যাম্প অশান্ত করার জন্য সন্ত্রাসী গ্রুপকে মিয়ানমার সরকার বিনামূল্যে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা সরবরাহ করছে। আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা এবং প্রত্যাবাসনকে বাধাগ্রস্ত করতে মিয়ানমার এই অপতৎপরতা চালাচ্ছে। টেকনাফ ও উখিয়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা বলছেন, মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মিই (আরসা) মূলত ক্যাম্পে তৎপর। আরসার সদস্যরা আল ইয়াকিন ও আরও ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে। তবে পুলিশ বলছে, দেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরসা বা আল ইয়াকিনের কোনো অস্তিত্ব নেই।
কুতুপালং ক্যাম্পে বসবাসকারী সাধারণ রোহিঙ্গারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দিনে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও রাতে ক্যাম্পে তাদের ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও প্রকট হচ্ছে। এরমধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে ঘিরেও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পাঁয়তারা করছে ক্যাম্পের ভেতরে থাকা সন্ত্রাসীরা।
এদিকে গত দুই বছরে ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে অন্তত ৪৫টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আরও ৩২ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়।
কুতুপালং ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ ইসমাইল ও টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা জাফর আহমদ বলেন, এমন অনেক রোহিঙ্গা রয়েছে যারা ক্যাম্পে থাকে না। তারা মাদক পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের কারণেই ক্যাম্পে অস্থিরতা। যেসব রোহিঙ্গা এসব অপরাধ করছে তারা ক্যাম্পে থাকে না। তবে এটা সত্যি, অপরাধ করার পর অনেকে ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, রোহিঙ্গাদের হামলায় স্থানীয়রা নিহত হয়েছে। এদের দমন করা না গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসাও হুমকির মুখে পড়বে।
পুলিশের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৭ মে পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ৩২ জন রোহিঙ্গা। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৬, মার্চে ১০, এপ্রিলে ৪ ও মে মাসে ৪ জন। টেকনাফ পুলিশের ভাষ্য, ৩২ রোহিঙ্গার মধ্যে পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ১৫ জন। নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশ ইয়াবা কারবারি। দুজন মানব পাচারকারী।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা অথবা আল ইয়াকিন নামের কোনো সংগঠনের তৎপরতা নেই। তবে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আরসা এবং আল ইয়াকিনের নাম ব্যবহার করে অপতৎরতা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে। অন্যদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও কর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরেই অন্তত ১৫ থেকে ২০টি সক্রিয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। এছাড়া ক্যাম্পকেন্দ্রিক রয়েছে আরও একাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। প্রত্যেক বাহিনীতে ৩০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের অভয়ারণ্য। গোলাগুলি, খুনাখুনিতে প্রতিনিয়ত জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। দিনের বেলা ক্যাম্পগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকলেও রাতে কিছুটা শিথিল থাকে।
কুতুপালং এলাকার ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকেই ইয়াবা কারবার নিয়ন্ত্রণ হয়। রোহিঙ্গারা সহজে সীমান্ত পার হয়ে মিয়ানমারে যাওয়া-আসা করতে পারছে। এ কারণে ইয়াবা ও স্বর্ণ চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এসব ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ক্যাম্পকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে অনেক সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। এতে করে খুনাখুনি ও অপরাধের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক কারবার, স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে ১২ থেকে ১৪টি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে বলে শুনতে পেয়েছি। তাদের দ্রুত নিশ্চিহ্ন করতে না পারলে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের পরিণতিও ভয়াবহ হতে পারে।
জানা গেছে, মাস্টার মুন্না গ্রুপ, মৌলভী ইউসুফ গ্রুপ, সাদ্দাম গ্রুপ, পুতিয়া গ্রুপ, শাহ আজম গ্রুপ, গিয়াস বাহিনী, সালমান শাহ গ্রুপ, আব্দুল হাকিম বাহিনী, নবী হোসেন বাহিনী, শুক্কুর বাহিনী, রকি বাহিনী, জাকির বাহিনীসহ সন্ত্রাসী গ্রুপ ও বাহিনী রয়েছে। আর আরসা হলো বড় গ্রুপ।
এসব গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছে মো. আব্দুল্লাহ ওরফে দাদা ভাই, বুলু, সুলতান, নবী হোসেন, সফিক, রফিক, মুর্তজা, হামিদুল্লাহ, আবদুস শুকুর, শরীফ হোসেন, মো. রহমান, সবেদ উল্লাহ, আব্দুল্লাহ, ফয়সাল, মো. সোলাম, হামিদ হোসেন, মুহিবুর রহমান, দিলদার, আবু সাইদ, তাহের, ফারুক, মুক্কুস, জুবায়ের, মুস্তফা, আব্দুল্লাহ আইদি, হাসন শরীফ, আব্দুল জলিল, হাফেজ উল্লাহ, আরমান খান, আইয়ুব, আমির হোসেন, নুর ইসলাম, আলী আকবর, কামাল, জাইবু রহমান, নাজিমুদ্দিন, সোনা উল্লাহ ও আরাফাত।
এ প্রসঙ্গে ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক পুলিশ সুপার (এসপি) মো. নাইমুল হক জানান, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তথাকথিত আরসা নামধারী সন্ত্রাসী সংগঠনের ১১৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চোরাকারবারি, ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত আরও ৫৮ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এপিবিএনের অধিনায়ক আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। আমরা চাই, সাধারণ রোহিঙ্গারা ভালো থাকুক। তথাকথিত দুর্বৃত্তদের গ্রুপের নাম করে কাউকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করতে দেওয়া হবে না।
এদিকে, এই অভিযানে মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার ১০ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে আজিজুল হক নামের একজনসহ তিন আসামি কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যমতে, চার বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছে ২ হাজার ৮৫০ রোহিঙ্গা। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, অস্ত্র ও মাদক পাচার, মানব পাচার, পুলিশের ওপর হামলা ইত্যাদি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৭০টি খুনের মামলা হয়েছে চার বছরে। এ সময় ৭৬২টি মাদক, ২৮টি মানব পাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে। ৩৪টি মামলা হয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায়। অন্যান্য অভিযোগে হয়েছে ৮৯টি মামলা। গেল ৪৮ মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘর্ষের ঘটনায় ২২৬ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও ৩৫৪ জন। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৬৩টি; যার আসামি ৬৪৯ জন। ২০২০ সালে ১৮৪ মামলায় ৪৪৯ আসামি।
সূত্র: দেশ রূপান্তর/ভয়েস/আআ